Hot Post

6/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

বঙ্গদেশীদের পিতাঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

বঙ্গদেশীদের পিতাঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান:

এক জীবনের পুরোটা সময়েই নিষ্পেষিত অধিকার বঞ্চিত সাধারণ গণমানুষের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন এমন নেতা পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়। সেই কম সংখ্যকদেরই একজন জন্মগ্রহণ করে ছিলেন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। সময়কাল ১৭ মার্চ ১৯২০ সাল। বাবা-মা তাঁকে আদর করে ডাকতেন খোকা বলে, সেই খোকাই যে একদিন বাঙালি জাতির ভাগ্য আকাশে মুক্তিদাতা হিসেবে আবির্ভূত হবেন তা হয়তো তাঁর বাবা-মা সেই সময়ে বুঝতেই পারনেনি। তারপর সেই খোকা থেকে শেখ মুজিব, শেখ মুজিব থেকে শেখ সাহেব তারপর বঙ্গবন্ধু, এই নামের ক্রমোন্নতির সাথে সাথে জড়িয়ে আছে বাঙালি জাতির ইতিহাস পরিক্রমা। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ছবি
ছবিঃ সংগৃহীত

ছোটবেলায় স্থানীয় জমিদার এবং নীলকরদের বিরুদ্ধে তাঁর পূর্বপুরুষদের প্রতিরোধ সংগ্রামের গল্প শুনতে শুনতে বড় হওয়া সেইদিনের সেই ছোট্ট খোকা তরুন বয়সেই জড়িয়ে পরলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে। পরিচিত হলেন তাঁর ভবিষ্যৎ রাজ‣নতিক দীক্ষাগুরু হোসেন শহীদসোহরাওয়ার্দীর সাথে। তারপর ভারত বিভক্তির আন্দোলন থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ঊনসত্তরের গনঅভ্যুত্থান তারপর সত্তরের নির্বাচন, রাজ‣নতিক প্রেক্ষাপট যতই উত্তাল হয়েছে ততই তিনি কেন্দ্রীয় ব্যক্তি হিসেবে ফুটে উঠেছেন। ফুটে উঠেছেন একটি ভূ-খন্ডের অধিকার বঞ্চিত জনসাধারণের প্রাণের নেতা হিসেবে। ব্রিটিশ শাসন আমলের সময় থেকে বরাবরই পূর্ব বাংলা প্রায় সর্বদিক দিয়েই পিছিয়ে ছিল। এখানকার জনসাধারণও ছিল দুর্দশাগ্রস্ত। এমনকি এই অঞ্চলের নামকরণ নিয়েও হয়েছে চক্রান্ত। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলার নাম দিতে চাইলো পূর্ব পাকিস্তান। বিতর্ক শুরু হয়ে গেল। প্রতিবাদের ধারাবাহিকতায় এলো ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। পূর্ব পাকিস্তানের মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেল বাংলা। এরপর এলো ১৯৫৭ সাল। বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তান গণপরিষদের একজন তরুণ সদস্য। করাচীতে পাকিস্তানের সেই গণপরিষদে বক্তৃতা দেয়ার সময় তিনি “পূর্ব পাকিস্তান” নামটির প্রতিবাদ করলেন। বললেন, “পূর্ব বাংলা নামের একটিইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে। আর যদি পূর্বপাকিস্তান নাম রাখতেই হয়, তাহলে বাংলার মানুষের জনমত যাচাই করতে হবে। তারা নামের এই পরিবর্তন মেনে নিবে কিনা - সেজন্য গণভোট নিতে হবে।”

এরপর ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ৬ষ্ঠ তম মৃত্যু বার্ষিকীতে আয়োজিত আওয়ামী লীগের সভায় বঙ্গবন্ধু দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “একটা সময় ছিল যখন এই মাটি আর মানচিত্র থেকে ‘বাংলা’ শব্দটি মুছে ফেলার সব ধরণের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। ‘বাংলা’ শব্দটির অস্তিত্ব শুধু বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যেত না। আমি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আজ ঘোষণা করছি যে, এখন থেকে এই দেশকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ এর বদলে ‘বাংলাদেশ’ ডাকা হবে।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের ছবি
ছবিঃ সংগৃহীত


অবশেষে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক-হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বাস্তবে স্বাধীনতা লাভ করল। বিশ্ব মানচিত্রে স্থান হলো নতুন একটি দেশের যে দেশের দুখী মানুষের ইতিহাসই হলো আন্দোলন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার ইতিহাস।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নয় মাসের অধিক সময় পাকিস্তান কারাগারে বন্দী থাকা শেখমুজিবুর রহমানকে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাকিস্তান সরকার ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো। পাকিস্তান ত্যাগ করার মুহূর্তে জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দিলেন কিন্তু বঙ্গবন্ধু সাফ জানিয়ে দেন, “আমি আগে আমার দেশের মানুষের সাথে দেখা করতে চাই, এর আগে কোন কথা নয়।” ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, সময় দুপুর ১ঃ৩০ মিনিটে রে․দ্র উজ্জ্বল ঢাকার আকাশে উড়ে এলো রূপালী নীল রঙের ব্রিটিশ রয়্যাল এ্যায়ার ফোর্সের কমেট জেট বিমান। বঙ্গবন্ধু জনতার মাঝে নেমে এলেন। লক্ষ লক্ষ জনতা তখন স্লোগান দিচ্ছে, “শেখ মুজিব, শেখ মুজিব,” “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।” 

তেঁজগাও বিমানবন্দর থেকে বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি নিয়ে আসা হলো রেসকোর্স ময়দানে, সেখানে তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক জনতার সামনে তাঁর জেল জীবনের বর্ণনা দিয়ে ভাষণ দিলেন। লন্ডন থেকে প্রকাশিত দি গার্ডিয়ান পত্রিকার ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স¤পাদকীয়তে বলা হয়, “শেখ মুজিব ঢাকা বিমানবন্দরে পদার্পণ করা মাত্র নতুন প্রজাতন্ত্র এক সুদৃঢ় বাস্তবতা লাভ করে।”সদ্য দেশে ফেরা বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ বিধ্বস্তদেশকে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা রূপে গড়ে তোলার জন্য আত্মনিয়োগ করলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণের আগে সারা দেশে রীতিমত যেন অবর্ণনীয় ধ্বংসকার্য চালিয়ে গেছে। রাস্তাঘাট সেতু কালভার্ট সব ধ্বংসপ্রায়, রেলযোগ এবংঅভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন একেবারেই ভেঙে পরেছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাংকনোট এবং কয়েন বিনষ্ট করে রেখে যায় ফলে যুদ্ধ শেষে মানুষ ব্যাপক নগদ টাকার সংকটে পড়ে। এদিকে ভারত ফেরত প্রায় এক কোটি শরনার্থীদের পুনর্বাসন, আইন শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠন, অ‣বধ অস্ত্র উদ্ধার, মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন, লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য খাদ্য সংগ্রহ, কৃষি উপকরণের ব্যবস্থাকরণ সবকিছু মিলিয়ে অগণিত সমস্যা মোকাবেলা করে দেশকে একেবারে শূন্য থেকে বিনির্মান শুরু করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর দেশ বিনির্মানের এই অভিযাত্রায় পশ্চিমা বিশ্ব থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর তেমন কোন সাহায্য সহযোগিতাই বঙ্গবন্ধু পাননি। এমনকি চীন সরকারও তখনবাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী ছিল। বঙ্গবন্ধু নবগঠিত রাষ্ট্রের সংবিধান প্রনয়ণ করলেন এবং পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতিতে ঘোষণা করলেন, “আমাদের একটি ক্ষুদ্র দেশ, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়, আমরা চাই সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব।” 

বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভের পর পাকিস্তানও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এরপর বাংলাদেশ রাষ্ট্র ওআইসি, জাতিসংঘ এবং জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্যপদ লাভ করে। বঙ্গবন্ধু এসময় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সফর করে বাংলাদেশের উন্নয়নকল্পে তহবিল সংগ্রহে সচেষ্ট হন। তাঁর সময়েই বাংলাদেশ - ভারত সম্পর্ক এক অনন্য মাত্রায় পেয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু ভারতের সাথে পঁচিশ বছর মেয়াদি মিত্রতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিতে ভারত সরকার বাংলাদেশকে অর্থনীতিক উন্নয়ন এবং দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তুলতে সাহায্যের আশ্বাস প্রদান করে। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধেই ভারতীয় সেনাবাহিনী ১৭ মার্চ ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের ভূ-খন্ড ত্যাগ করে। এভাবেই দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে। ১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ দেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধি
ছবিঃ সংগৃহীত

নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয় লাভকরে। দলটি ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসন লাভ করে। এরপর বঙ্গবন্ধু দেশের প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, খাদ্য, পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতকল্পে রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডের বিস্তৃতি ঘটাতে থাকেন। এতো কিছু সত্ত্বেও উগ্র বামপন্থীদের তরফ থেকে অভিযোগ আসা শুরু হয়। তারা বলতে থাকে স্বাধীনতা যুদ্ধ একটি অসম্পূর্ণ বিপ্লব। তারা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি আর দেশ চালানোয় অদক্ষতার অভিযোগ আনে।

দেশে শুরু হয় চরম বিশৃঙ্খলা। স্বাধীনতার পরে দেশের জনগণের মনে আবার নেমে আসে হতাশা। ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে সমস্যা আরো প্রকট হয়। এর সাথে রক্ষিবাহিনীর কার্যকলাপ জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে বঙ্গবন্ধু বাকশাল কায়েম করতে সচেষ্ট হন এবং বাকশালকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরে "দ্বিতীয় বিপ্লব" হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু বাকশালের রূপরেখা কায়েম করার আগেই আসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট। একদল সেনা কর্মকর্তা ট্যাংক নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ধানম-িস্থ বাসভবন ঘেরাও করে এবং নির্বিচারে গুলি চালিয়ে বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাঁর দুই কন্যা দেশে না থাকার কারণে ঐদিনের সেই নারকীয় হত্যাকান্ড থেকে বেঁচে যায়। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ছবি
ছবিঃ সংগৃহীত

কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো একসময় শেখ মুজিবকে হিমালয় পর্বতের সাথে তুলনা করে বলেছিলেন, “আমি হিমালয় দেখেনি কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি।” যে হিমালয়ের মত মানুষটি সারাটি জীবন শুধু জনগণের মুক্তির জন্যই অসংখ্যবার জেলজীবন কাটিয়েছেন সেই তাঁকেই এই দেশের মানুষরূপী কিছু হিংস্র জানোয়ারের হাতে প্রাণ দিতে হলো। জাতি হিসেবে এই লজ্জা ঢাকবার কোন রাস্তা আমাদের জানা নেই। এরপরও ষড়যন্ত্র চলতে থাকে, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে সেই ঘৃন্য হত্যাকারীদের বিচার থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সব ধরনের মিডিয়ায় তাঁর ছবি ও কথা প্রচারের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। বঙ্গবন্ধুএক সময় বলেছিলেন এই দেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড। তিনি সমালোচকদের উদ্দেশ্যে বলতেন, “ভুলে যেওনা আমি মাত্র তিনবছর সময় পেয়েছি। এই সময়ের মধ্যে তোমরা কোন দৈব পরিবর্তন আশা করতে পারো না।”

দেশ স্বাধীনের প্রায় পঞ্চাশ বছর হতে চললো আমরা এখনও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মান করতে পারিনি। এই দেশেরপ্রতিটি মানুষ যেদিন দেশপ্রেম নিয়ে ন্যায় নিষ্ঠার সাথে তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হবে সেই দিনই বাস্তবায়িত হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। শান্তিপাবে বঙ্গবন্ধুর আত্মা, শান্তি পাবে মুক্তিযুদ্ধে আত্মউৎসর্গকারী ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মা।


[গ্রন্থপুঞ্জিঃ কারাগারের রোজনামচা, অসমাপ্ত, আত্মজীবনী, উপন্যাস-দেয়াল, বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া, বিদেশী পত্রিকা ও ম্যাগাজিন, বিভিন্ন ওয়েবসাইট।]

Post a Comment

0 Comments