Hot Post

6/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ও পলাশীর যুদ্ধ

সিরাজ-উদ-দৌলার পরিচয়: 

নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ও পলাশীর যুদ্ধ

সিরাজ-উদ-দৌলা ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। তিনি ছিলেন নবাব আলীবর্দী খানের দৌহিত্র। নবাব আলীবর্দীর কোনো পুত্র-সন্তান ছিল না। তিনি তাঁর তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন বড় ভাই হাজী আহমদের তিন ছেলের সাথে। ছোট মেয়ে আমিনা বেগমের বিয়ে হয়েছিল জয়েনউদ্দীনের সাথে। সিরাজ ছিলেন জয়েনউদ্দীন ও আমিনা বেগমের বড় ছেলে। সিরাজকে তাঁর মাতামহ আলীবর্দী খান খুবই ভালবাসতেন।

সিংহাসন লাভ: 

১৭৫৬ সালের ১০ই এপ্রিল আলীবর্দী খানের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পূর্বে তিনি সিরাজকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান। ফলে সিরাজ মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে আরোহণ করেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৩ বছর। সিরাজ সিংহাসনে বসায় তাঁর আত্মীয়-স্বজনেরা অনেকেই ঈর্ষান্বিত হন। খালাত ভাই শওকত জং ছিলেন তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁর বড় খালা ঘসেটি বেগম শওকত জং-এর পক্ষ অবলম্বন করেন। সিরাজ শওকত জং-কে পূর্ণিয়ার যুদ্ধে পরাজিত করেন। তিনি ঘসেটি বেগমকেও নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হন।

ইংরেজদের সাথে বিরোধ: 

সিংহাসন লাতের অল্পকাল পরেই ইংরেজদের সাথে সিরাজ-উদ-দৌলার বিরোধ বাধে। এ বিরোধের পেছনে কতকগুলো কারণ ছিল। প্রথমত, সিরাজ-উদ-দৌলা সিংহাসনে বসলে রেওয়াজ অনুযায়ী ইংরেজরা তাঁকে কোনো উপঢৌকন পাঠায়নি। দ্বিতীয়ত, ইংরেজরা সিরাজ-উদ-দৌলার প্রতিদ্বন্দ্বী ঘসেটি বেগম ও পূর্ণিয়ার নবাব শওকত জং-কে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছিল। তৃতীয়ত, রাজা রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাস নবাবের বিরাগভাজন হয়ে কলকাতায় পালিয়ে গেলে ইংরেজরা তাকে সাদরে আশ্রয় দেয়। চতুর্থত, কোম্পানির কর্মচারীরা বাণিজ্যিক বিশেষ সুবিধাসমূহের যথেচ্ছা অপব্যবহার করছিল। পঞ্চমত, ইংরেজরা কলকাতায় এবং ফরাসিরা চন্দননগরে দুর্গ নির্মাণ শুরু করলে সিরাজ-উদ-দৌলা তাদেরকে দুর্গ নির্মাণের কাজ বন্ধ করার আদেশ দেন। ফরাসি বণিকেরা তাঁর আদেশ মেনে নেয়। কিন্তু ইংরেজরা তাঁর আদেশ অগ্রাহ্য করে দুর্গ নির্মাণের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। এ সব কারণে সিরাজ-উদ-দৌলা ইংরেজদের সমুচিত শাস্তি দেওয়ার জন্য কলকাতা আক্রমণ করে ইংরেজদেরকে শহর থেকে বিতাড়িত করেন। তিনি কলকাতার নতুন নাম দেন আলীনগর। অতঃপর আলীনগরের (কলকাতার) শাসনভার মানিক চাঁদের ওপর ন্যস্ত করে তিনি মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন।

কলকাতা পতনের খবর মাদ্রাজে পৌঁছলে সেখানকার কর্তৃপক্ষ কলকাতা পুনর্দখল করার জন্য রবার্ট ক্লাইভ ও নৌ সেনাপতি ওয়াটসনকে পাঠান। এদিকে কলকাতা অধিকৃত হওয়ায় দেশীয় স্বার্থান্বেষী বণিক সম্প্রদায় প্রমাদ গুণতে শুরু করে। তারা কলকাতা থেকে বিতাড়িত এবং ফলতায় অবস্থানরত ইংরেজদের সাথে গোপনে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। অন্যদিকে ইংরেজরাও কলকাতার অধিকর্তা মানিকচাঁদ, ধনাঢ্য বণিক উমিচাঁদ, ব্যাংকার জগৎশেঠ প্রমুখ ব্যক্তিদেরকে হাত করে ফেলে। এমতাবস্থায় ক্লাইভ ও ওয়াটসন কলকাতা পুনরুদ্ধার করতে এলে বিশ্বাসঘাতক মানিক চাঁদ তাদেরকে বাধা না দিয়ে কলকাতা থেকে পালিয়ে যান। ফলে ক্লাইভ ও ওয়াটসন প্রায় বিনা যুদ্ধেই কলকাতা পুনর্দখল করে নিতে সক্ষম হন। এ সংবাদ পেয়ে সিরাজ-উদ-দৌলা পুনরায় কলকাতা অভিমুখে অগ্রসর হন এবং শেষ পর্যন্ত ইংরেজদেরকে পিছু হটতে বাধ্য করেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন বিরাজমান পরিস্থিতি- যেমন তাঁর সেনাপতির বিশ্বস্ততা সম্পর্কে তাঁর সন্দেহ, আহমদ শাহ আবদালী কর্তৃক বিহার আক্রমণের সম্ভাবনা ইত্যাদির কথা বিবেচনা করে তিনি ইংরেজদের সাথে সন্ধি করেন। এ সন্ধি আলীনগরের সন্ধি নামে পরিচিত। সন্ধির শর্তানুযায়ী সিরাজ-উদ-দৌলা ইংরেজদেরকে অনেক ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হন। তাদের বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধাদিও বাড়িয়ে দেন। বিনিময়ে ইংরেজগণ নবাবের সাথে শত্রুতা করবেন না বলে অঙ্গীকার করে।

নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র: 

ইংরেজদের সাথে সন্ধি স্থাপিত হলেও রবার্ট ক্লাইভ কখনও সিরাজ-উদ-দৌলাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেননি। তিনি সিরাজ-ফরাসি জোটের আশঙ্কায় সিরাজ-উদ-দৌলাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সচেষ্ট হন। অপরদিকে এ সময়ে মুর্শিদাবাদ দরবারে নবাবের বিরোধী দল জগৎশেঠের মনোনীত প্রার্থী মীর জাফরকে নবাবী দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র চলছিল। রবার্ট ক্লাইভ মীর জাফরকে সমর্থন করে ইংরেজদের স্বার্থে এ ষড়যন্ত্রে যোগ দেন।

পলাশীর যুদ্ধ: 

The Battle of Plassey

আলীনগরের সন্ধি স্বাক্ষরের মাত্র আড়াই মাস পরেই ইংরেজরা সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে। তারা ফরাসিদের চন্দননগর কুঠি দখল করে নেয়। এরপর ষড়যন্ত্র অনুযায়ী ক্লাইভ তার সেনাবাহিনী নিয়ে মুর্শিদাবাদের দিকে যাত্রা করেন। নবাবও তাদেরকে বাধা দেওয়ার জন্য অগ্রসর হন। মুর্শিদাবাদের ২৩ মাইল দক্ষিণে পলাশীর প্রান্তরে নবাব সেনা সমাবেশ করেন। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মীর জাফর, ইয়ার লতিফ ও রায়দুর্লভের সৈন্যগণ যুদ্ধ না করে দাঁড়িয়ে থাকে। মীরমদন, মোহনলাল ও ফরাসি সেনানায়ক সিনফ্রে প্রাণপণে যুদ্ধ করেন। ইংরেজ বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। হঠাৎ একটা গোলার আঘাতে মীরমদনের মৃত্যু হয়। মীরমদনের মৃত্যুতে নবাব খুব ভেঙ্গে পড়েন। তিনি মীর জাফরকে তাঁর শিবিরে ডেকে পাঠান। মীর জাফর তাঁর সামনে হাজির হলে তিনি তাঁর নিকট কাতরভাবে সাহায্য চান। মীর জাফর নবাবকে সেদিনের মতো যুদ্ধ বন্ধ করার পরামর্শ দেন। নবাব তাঁর পরামর্শ মতো যুদ্ধ বন্ধ করে ভুল করলেন। যুদ্ধ বন্ধ করার আদেশ দেওয়ায় নবাবের সৈন্যগণ তাঁবুতে ফিরে যচ্ছিল। এ সুযোগে ক্লাইভ নবাব বাহিনীকে আক্রমণ করলেন। হঠাৎ আক্রমণে নবাবের সৈন্যগণ বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ল। তারা এদিকে-ওদিকে পালাতে লাগল। বিশ্বাসঘাতকতার কারণে নবাব পরাজিত হন।

সিরাজের হত্যা: 

নবাব মুর্শিদাবাদে ফিরে এলেন। তিনি স্থির করলেন পাটনা যাবেন। সেখানে সৈন্য সংগ্রহ করে আবার যুদ্ধ করবেন। কিন্তু পথে রাজমহলের কাছে তিনি ধরা পড়েন। তাঁকে বন্দি করে মুর্শিদাবাদ নিয়ে আসা হয়। মীর জাফরের পুত্র মীরনের আদেশে মোহম্মদী বেগ নামক একজন ঘাতক নবাবকে হত্যা করে। নবাব সিরাজ-উদ- দৌলা বাংলা ও বাংলার জনগণকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন।

পলাশীর যুদ্ধের ফলাফল: 

পলাশীর যুদ্ধের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। প্রথমত, এ যুদ্ধের ফলে ইংরেজদের সাহায্যে মীর জাফর বাংলার সিংহাসনে বসেন। কিন্তু তিনি ছিলেন নামে মাত্র নবাব। প্রকৃত ক্ষমতা চলে গিয়েছিল ইংরেজদের হাতে। দ্বিতীয়ত, পলাশীর যুদ্ধের ফলে ব্রিটিশ এলাকা সম্প্রসারিত হয় এবং কোম্পানির আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়। তৃতীয়ত, প্রকৃত ক্ষমতা ইংরেজদের হাতে চলে গেলে কোম্পানির মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। চতুর্থত, পলাশীর যুদ্ধ দাক্ষিণাত্যে ইংরেজ-ফরাসি সংঘর্ষকে প্রভাবিত করে। এ যুদ্ধের ফলে ইংরেজরা বাংলার ধন-সম্পদ লাভ করে আর্থিক দিক দিয়ে যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ইংরেজদের এ আর্থিক সচ্ছলতাই তাদেরকে তৃতীয় কর্নাটের যুদ্ধে ফরাসিদেরকে পরাজিত করতে বহুলাংশে সাহায্য করে। পঞ্চমত, এ যুদ্ধের ফলে বাংলা স্বাধীনতা হারায় এবং উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের সূত্রপাত হয়।

সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের কারণ: 

সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের জন্য দায়ী ছিলেন তাঁর সেনাপতি মীর জাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, জগৎশেঠ, দিউয়ান রাজবল্লভ, উমিচাঁদ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। কারণ তারাই ষড়যন্ত্র করে নবাবকে পলাশীর যুদ্ধে পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করেছিলেন। তবে তাঁর পরাজয়ের জন্য তিনি নিজেও কিছুটা দায়ী ছিলেন। তিনি পরিস্থিতি মোকাবিলায় দৃঢ়চিত্তের পরিচয় দিতে পারেননি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিশেষভাবে মনে রাখা প্রয়োজন যে, তিনি যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন বাংলার পরিবেশ ও পরিস্থিতি তাঁর অনুকূলে ছিল না। সংকীর্ণ স্বার্থপরতা, দুর্নীতি, বিশ্বাসঘাতকতা প্রভৃতিতে সমাজ জীবন তখন ছিল কলুষিত। সে সময়ে কাউকেই বিশ্বাস করার পরিবেশ ছিল না। বাংলার এহেন পরিবেশে অভিজ্ঞ ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গও কতটুকু সাফল্য লাভ করতে পারতেন, তা বলা কঠিন ছিল।

Post a Comment

0 Comments